মানুষের ভগবান তৈরির কারখানা কুমোরটুলি


ঢাকে কাঠি, পাড়ার গলিতে বাঁশ, রাস্তায় রাস্তায়, পাড়ার মোড়ে মোড়ে নানান অ্যাড, টিভিতে পুজোর প্রস্তুতি নিয়ে মাতামাতি, আর কিছু বছর যাবত সোশ্যাল মিডিয়ায় কাশ ফুলের ছবি মনে করিয়ে দেয়ে মা আসছেন। শহরের, বিশেষত কলকাতার মানুষের কাছে, না শরতের আকাশ বা শুভ্র কাশফুল কোনটাই মা দুর্গার আগমন বার্তা নিয়ে আসেনা আজকাল। হয়তো, আমার ভাবনাটাই ভুল। সে যাই হোক, পুজোর আঁচ যেখানে সর্বপ্রথম এসে পড়ে, সে কিন্তু কুমোরটুলিতে। ভাবতেই অবাক লাগে কংক্রিটের জঙ্গলে এক টুকরো কুমোরপাড়া আজও জীবিত। আমার শৈশবে দেখা কুমোরটুলি আর আজকের কুমোরটুলির চেহারায় আমুল পরিবর্তন না হলেও, চরিত্রগত পরিবর্তন হয়েছে আনেকটাই। সবারই নিজের নিজের মত করে “শৈশব স্মৃতি” থাকে, সেইভাবে আমার মত করে রাখা আমার “শৈশব স্মৃতি” থেকে কিছু কথা মিশবে হয়ত এই লেখায়। এই পুজো এলে, এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়, আর ঠিক তক্ষুনি কিছু টুকরো টুকরো ছবি জল ছবির মত স্মৃতির পাতা থেকে উঠে আসে। আমাদের অজান্তেই প্রকৃতি আমাদের সাথে অদ্ভুত একটা খেলা খেলে।

মানুষের পাকস্থলিই হয়তো সব রহস্যের উৎসস্থল, আর তারি টানে মানুষ ছুটে বেড়ায় সারা জীবন এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। ঠিক একি নিয়মে সপ্তদশ শতাব্দীতে কোন এক সময় কৃষ্ণনগরের কিছু পটুয়া গোবিন্দপুরে চলে আসেন, আর গড়ে ওঠে পটুয়াপারা। পাসেই মা গঙ্গা, তাঁর মাটি সহজলভ্য, তাই সেখানেই গড়ে উঠল আমাদের আজকের কুমোরটুলি। বর্তমানের কুমোরটুলির দুটি অংশ, একটি পুরনো কুমোরটুলি আরেকটি নতুন কুমোরটুলি। বর্ধিত বা নব্য কুমোরটুলি আমার সাথেই হয়ত বড় হয়েছে, তাই পুরনো কুমোরটুলি অংশটাই আমার কাছে আজও বেশি আকর্ষণীয় ও প্রিয় বটে। ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে পুজর আগে ঠাকুর দেখার এক অদ্ভুত মজা ছিল জানেন। হাতে সিগারেট আসার পর, বর্তমান স্ত্রী, যিনি তখন গার্লফ্রেন্ড তিনি হলেন নতুন কুমোরটুলি সঙ্গী। সময় ও চোখ দুটোই বদলে গেলো আমার অগোচরে। গার্লফ্রেন্ডের স্ত্রী হয়ে ওঠার পরেও রেশ ছিল বেশ কিছু বছর। এর পর জুটল এক জঙ্গল মানুষ যারা কুমোরটুলির ছবি তোলে। বুঝতে পারছিলাম আমার কাছে কুমোরটুলি নামক আত্মার মৃত্যু হচ্ছে, ক্রমে ক্রমে। সেই শীর্ণ রাস্তা, জল চুয়ানো ছাদ, রাস্তায় পরে থাকা ময়লা, কঙ্কালের মত কিছু মূর্তি, যাদের দেখলে বোঝা দায় এ কোন দেব কোন দেবী, এটাই কুমোরটুলির নিত্ত সঙ্গী। বেশ কিছু বা সাম্প্রতিক কিছু বছর ধরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের কোটি কোটি ফটোগ্রাফারের দল ঢুকে পরেছে এইখানে। আজকাল, তাই পুজর আগে যেতে ভাল লাগে না। ছবি তুলতে গিয়ে যদি ফটোগ্রাফারদের ছবি তুলতেই হয়, তার থেকে না যাওয়াই ভাল। আগে যখন ছবি তুলতে যেতাম, শিল্পীরা নিজেই সুযোগ করে দিতেন ছবি তোলার জন্য, আজকাল বিরক্ত হন তারাই। আজকাল, ফটোগ্রাফারদের ভিড় সামলানোর জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিকিট কাটার পরেই ছবি তুলতে পারবেন।

যাইহোক, এটা ভেবেও ভাললাগে যে, কুমোরটুলির আকর্ষণ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। কুমোরটুলির শিল্পের নৈপুণ্য কলকাতার গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে সমাদৃত। তাই বিশ্ব বাজারে প্রতিমার চাহিদা মেটাতে প্রত্যেক বছর আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আরও নানান দেশে প্রতিমা রপ্তানি হয় এই কুমোরটুলি থেকে। এটা ভাবতেও ভাললাগে যারা এক সময় আমাদের দেশকে নিজেদের দেশ বলে ভুল করেছিল তাদের দেশেই মায়ের পুজোর জন্য প্রতিমা যাচ্ছে।
সময় বদলে গেছে খুব দ্রুত আর অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে সে আঁচও পরেছে এখানে। আসলে সবটুকই ঠিক করে দেয় বাজার। প্রতিমা নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চক্ষুদান, আর এই চক্ষুদান পর্বটা হয় মহালয়ার দিন। কথিত আছে, এই দিন মা তার সকল সন্তানদের সঙ্গে করে মর্তে আসেন। আজকাল, এই রীতির বিসর্জন দিয়েছেন শিল্পীরা। চক্ষুদান করার জন্য আলাদা শিল্পীদল আছেন। প্রতিমা তৈরি হয়ে গেলে তারা আসেন লাইন ধরে মায়ের চোখ এঁকে দিয়ে চলে যান। আমরা যারা তথাকথিক পুরনো কলকাতায় বড় হয়েছি, তাদের স্মৃতিতে ও কল্পনায় বারবনিতার বাড়ির মাটি ও প্রতিমা নির্মাণের এক অদ্ভুত ছবি ভেসে ওঠে।
বলতে গেলে আজ আর এসব মূল্যহীন। সবটাই দখল করেছে বাজার বা বলা যেতে পারে বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন বাজার সংস্কৃতি। আসলে মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে উঠলেই বাজার আর বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই মাটির প্রতিমা আবার কাদামাটিতেই পাল্টে যায়, সেটা আরেক নতুন বাজারের জন্মের বীজ রোপণ। আর এভাবেই সৃষ্টি চক্রাকারে আবর্তনশীল হতে থাকে বছরের পর বছর আর যুগের পর যুগ। কুমোরটুলি রয়ে যায় কুমোরটুলিতে আর ভগবান তৈরির কারিগর বদলে যায় যুগের পরিবর্তনে।